ছোট বেলায় বাবা - মায়ের হাত ধরে যেতাম নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে | ভেতরে ভেতরে খুব আনন্দ হতো |নানা রকমের অনুষ্ঠান , আর ছোট বড়ো নানা রকমের প্যান্ডেল | কখনো অনুষ্ঠান বাড়ির পাশের ফাঁকা জায়গায় তো কখনো বাড়ির ছাদে | স্কুলের কায়দায় বসার বেঞ্চ , সামনে খাওয়ার বেঞ্চ | খাওয়ার লম্বা বেঞ্চগুলোর উপর সাদা কাগজে ঢাকা | গুটিগুটি লাজুক লাজুক মুখে বসতেই , সামনে খ্যাবার টেবিলে দেওয়া হতো কাটা কলাপাতা , কখনো বা হাতে তৈরি শালপাতার থালা |
প্রথমেই পাতাগুলোতে পড়ে যেত নুন আর লেবু | তারপর গরম গরম ভাত , বাহারি মুগের ডাল আর অবশ্যই ''এক পিস্ সরু লম্বা বেগুন ভাজা '' | বেগুন ভাজা !!!এই বেগুন ভাজাটা কিন্তু থাকতোই থাকতো | আর খেতেও খুবই ভালো লাগতো | পাতে বেগুনভাজাটা পড়লেই , মন যেন বলে উঠতো ...নেমন্তন্ন খেতে এসেছি !! আজ আমরা সব্বাই নেমন্তন্ন খেতে এসেছি |
সময় এগিয়ে চলেছে | সব অনুষ্ঠান পদ্ধতি ও বদলে বদলে যাচ্ছে , অনুষ্ঠান গুলোতেও খাওয়া দাওয়ার পদ্ধতিও ক্রমশই পাল্টে পাল্টে যাচ্ছে | কিন্তু আমাদের ঘরে ঘরে প্রিয় বেগুনভাজা আমাদের আছেই ...... সেটা কোনো ছুটির দিনেই হোক বা কোনো স্পেশাল দিনেই হোক | বেগুন ভাজা , বা বেগুনি বা বেগুন দিয়ে শুক্তো ......কোনো না কোনো পদ থাকবেই থাকবে | বেগুন যারা খেতে ভালোবাসেন তারাই জানেন , বেগুনের যে কোনো মেনুই খেতে কিন্তু বেশ ভালো লাগে | কারোর কারোর কাছে ,রোজ রোজ বেগুন - মেনু খেলেও বিরক্তি আসে না |
অনেকেরই ভাবনা ...বেগুন ... বে - গুন্ ....নাই গুন্ | মোটেও নয় ...মোটেও নয় | বরঞ্চ বলা যেতেই পারে , গুনের উপর গুন্ ...তারই নাম ' বেগুন ' | নানা ভিটামিনে সমৃদ্ধ বেগুন ....প্রাকৃতিক এক মহা - ঔষধের ভান্ডার | যেমন ভয়ঙ্কর রোগ ডায়াবেটিস নিরাময়ে বেগুনের ভূমিকা অপরিসীম | তেমনি উচ্চরক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে ম্যাজিক এনে দেয় বেগুন | ফাইবারে ঠাসা বেগুন ...ওজন ও কমিয়ে দেয় | মোটকথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে বেগুন সুন্দরী .............আমাদের নানা রোগ প্রতিরোধে নানা নানা ভাবে সাহায্য করেই চলেছে ...........করেই চলেছে |
আমার রান্নাঘরেও যে আজ বেগুন রয়েছে ,এটা বোধহয় আপনারা সবাই এতক্ষনে বুঝেই ফেলেছেন | রয়েছে ...রয়েছে ...খুব টাটকা , আঙুলের মতো সরু সরু লম্বা লম্বা কয়েকটা বেগুন | দেখেই যেন মন খুশি খুশি হয়ে ওঠে | সঙ্গে সঙ্গে ভেবেই নিলাম , এই সুন্দরী বেগুন গুলো দিয়ে আজ ...খুব টেস্টি টেস্টি করে রাঁধবো ''বেগুন - পোস্ত | সবার স......বার খুবই পছন্দের | গরম ভাতে ...প্রথম পাতে.....আহা - হা - হা ভাবতেই...জিভে জল | আজকের সকালের সব্বাইকে খুশি খুশি করে দিয়ে , সকালের সকল কর্ম সেরে টেরে নিয়ে , একেবারে পৌঁছে গেলাম , প্রিয় রান্নাঘরে ....দুপুরের টেস্টি টেস্টি মেনু ......' বেগুন - পোস্ত '' (Begun - Posto) তৈরি করতে |
উপকরণ :-
বেগুন - ৫০০ গ্রাম , লম্বালম্বি দু টুকরো করে নিয়ে , প্রতিটি টুকরো আবার ২-৩ টুকরো করে কাটা (কাটা টুকরোগুলো জলে ধুয়ে নিয়ে , জল ঝরিয়ে রাখা)
পোস্ত - ৫০ গ্রাম , জলে ভিজিয়ে রাখা
কাঁচালঙ্কা - গোটা গোটা , নিজেদের পছন্দমতো
পাঁচফোড়ন - ১/২ চামচ
গোটা শুকনোলঙ্কা - ২-৩টি
হলুদগুঁড়ো - ১/৪ - ১/২ চামচ , খু....ব অল্প দিলেই ভালো হয় , পোস্ত তে হলুদ না দিলেও চলে , কিন্তু যেহেতু বেগুন টেস্টি টেস্টি করবো , তাই এক চিমটি দেব
নুন - প্রয়োজনমতো
চিনি - প্রয়োজনমতো , বেগুনের যে কোনো রান্নায় অল্প চিনি , রান্নার স্বাদে চমক এনে দেয়
সর্ষের তেল - প্রয়োজনমতো , যে কোনো তেলেই রান্না হবে , তবে বেশি টেস্টি টেস্টি হয়ে উঠবে সর্ষের তেলে
পদ্ধতি :-
রান্নার কিছু কিছু কাজ সকালের নানা কাজের মধ্যেই এগিয়ে রেখেছি | এবার রান্নাঘরে ঢুকে প্রথমেই জলে ভেজানো পোস্ত মিক্সিতে নিয়ে , তার মধ্যে দিয়ে দিলাম ৪-৫ টি গোটা কাঁচালঙ্কা ( আপনারা দেবেন আপনাদের পছন্দমতো ) | দিলাম এক চিমটে নুন | মিহি করে বেটে রেখে দিলাম | এবার গ্যাসে কড়াই চাপিয়ে , দিলাম প্রয়োজনমতো তেল |
তেল গরম হলে আঁচ কমিয়ে কড়াইতে ছেড়ে দিলাম , কেটে ধুয়ে রাখা বেগুনের টুকরোগুলো | দিলাম একচিমটি নুন , একচিমটি হলুদগুঁড়ো , ১/২ চা চামচ থেকেও অল্প চিনি | তবে কিন্তু বেগুন স্বাদে চিনি টেনে নিয়ে স্বাদের আকর্ষণ বাড়ায় |যাহোক , এবার আঁচ বাড়িয়ে বেগুনের টুকরোগুলো ভালো করে ভেজে নিয়ে , তেল থেকে তুলে একটা পাত্রে রেখে দিলাম| এবার কড়াইয়ের ওই তেলের মধ্যেই প্রয়োজনমতো অল্প তেল দিয়ে আঁচ বাড়িয়ে দিলাম | তেল গরম হলে আঁচ কমিয়ে ফোরণে দিলাম একটা
ফাটানো কাঁচালঙ্কা , ২-৩টি ফাটানো শুকনোলঙ্কা আর ১/২ চামচ মতো পাঁচফোড়ন | ঢেলে দিলাম মিক্সিতে বেটে রাখা পোস্ত | আঁচ বাড়িয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে দিলাম , প্রয়োজনমতো নুন , প্রয়োজনমতো কয়েকদানা চিনি আর এ......ক চিমটি হলুদগুঁড়ো ( না দিলেও চলবে ) | দিয়ে দিলাম প্রয়োজনমতো অল্প জল |
পোস্ত এর রসা ফুটতে শুরু করলেই , আঁচ কমিয়ে , ভেজে রাখা বেগুনের টুকরোগুলো , আর বাকি কটা গোটা কাঁচালঙ্কা কড়াইতে দিয়ে দিলাম | আঁচ বাড়িয়ে খুব হালকা হাতে খুন্তি দিয়ে রান্না নেড়েচেড়ে নিলাম | আবার আঁচ কমিয়ে রান্না অল্প সময়ের জন্য মজতে দিলাম | সু...ন্দর এক মনোরম গন্ধে চারিদিক মো মো ...মো মো করছে | মাঝে মাঝে বাড়ির লোকজনের ও আনন্দের আর খুশির আভাস , রান্নাঘর থেকেই পাচ্ছি | এবার রান্না চেখে নিলাম | সত্যিই অপূর্ব ....অ......পূর্ব লাগছে | রসা শুকিয়ে রান্না টানটান করে নিলাম | গ্যাস বন্ধ করলাম | রান্না একটা ছড়ানো পাত্রে ঢেলে নিয়ে , দিলাম ঢাকা |
যথারীতি দুপুরের খাওয়ার সময়ে , আমরা সব্বাই খাওয়ার টেবিলে | আর অপেক্ষা করা যাচ্ছে না | আমরা খাওয়া শুরু করলাম , গরম গরম ভাত আর স্বাদিষ্ট বেগুন - পোস্ত দিয়ে (Begun - Posto) | ওঃ হো ,ওঃ হো হো ! খেতে যে বড়োই ভালো ! বড়োই ভালো !! স্বাদের তৃপ্তিতে মন ভরে যাচ্ছে | আমাদের মধ্যে অনেকেই অন্য কিছুই চাইলো না | শুধু আর একবার চেয়ে নিলো আরো একটু ...'' বেগুন - পোস্ত '' | স্বাদের- খাবার ....খাওয়াতে যে কি সুখের পরশ , তা আমি আমার বাড়ির পরিবেশেই বুঝতে পারছি | অনেক আনন্দ ...অনেক আনন্দ ...আর অনেক আনন্দ ............
আনন্দে থাকুন , ভালো খান , ভালোবেসে খান | অনেক অ..............নেক সুস্থ থাকুন |
Comments